কুড়ি

কুড়ি


প্রায় মাসাধিক-কাল গত হইয়াছে। আগ্রায় ইন্‌ফ্লুয়েঞ্জার মহামারী মূর্তিটা শান্ত হইয়াছে;স্থানে স্থানে দুই-একটা নূতন আক্রমণের কথা না শুনা যায় তাহা নয়,তবে,মারাত্মক নয়। কমল ঘরে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে সেলাই করিতেছিল,হরেন্দ্র প্রবেশ করিল। তাহার হাতে একটা পুঁটুলি,নিকটে মেঝের উপর রাখিয়া দিয়া কহিল, যে-রকম খাটচেন তাতে তাগাদা করতে লজ্জা হয়। কিন্তু লোকগুলো এমনি বেহায়া যে দেখা হলেই জিজ্ঞেসা করবে,হলো? আমি কিন্তু স্পষ্টই জবাব দিই যে, ঢের দেরি। জরুরী থাকে ত না হয় বলুন, কাপড় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু মজা এই যে, আপনার হাতের তৈরী জিনিস যে একবার ব্যবহার করেচে, সে আর কোথাও যেতে চায় না। এই দেখুন না লালাদের বাড়ি থেকে আবার এক থান গরদ,আর নমুনার জামাটা দিয়ে গেল—


কমল সেলাই হইতে মুখ তুলিয়া কহিল, নিলেন কেন?


নিই সাধে? বললাম ছ মাসের আগে হবে না,—তাতেই রাজী। বললে, ছ মাসের পরে ত হবে তাতেই চলবে। এই দেখুন না মজুরির টাকা পর্যন্ত হাতে গুঁজে দিয়ে গেল।।এই বলিয়া সে পকেট হইতে একখানা নোটের মধ্যে মোড়া কয়েকটা টাকা ঠক্‌ করিয়া কমলের সম্মুখে ফেলিয়া দিল।


কমল কহিল, অর্ডার এত বেশী আসতে থাকলে দেখচি আমাকে লোক রাখতে হবে। এই বলিয়া সে পুঁটুলিটা খুলিয়া ফেলিয়া পুরানো পাঞ্জাবি জামাটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়া কহিল, কোন বড় দোকানের বড় মিস্ত্রীর তৈরী,—আমাকে দিয়ে এ রকম হবে না। দামী কাপড়টা নষ্ট হয়ে যাবে, তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন।


হরেন্দ্র বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল,আপনার চেয়ে বড় কারিগর এখানে কেউ আছে নাকি?


এখানে না থাকে কলকাতায় আছে। সেইখানেই পাঠিয়ে দিতে বলবেন।


না না, সে হবে না। আপনি যা পারেন তাই করে দেবেন, তাতেই হবে।


হবে না হরেনবাবু, হলে দিতাম। এই বলিয়া সে হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, অজিতবাবু বড়লোক, শৌখিন মানুষ, যা-তা তৈরি করে দিলে তিনি পরতে পারবেন কেন? কাপড়টা মিথ্যে নষ্ট করে লাভ নেই,আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান।


হরেন্দ্র অতিশয় আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, কি করে জানলেন এটা অজিতবাবুর?


কমল কহিল,আমি হাত গুণতে পারি। গরদের কাপড়, অগ্রিম মূল্য,অথচ ছ’মাস বিলম্ব হলেও চলে,—হিন্দুস্থানী লালাজিরা অত নির্বোধ নয়, হরেনবাবু। তাঁকে জানাবেন—তাঁর জামা তৈরি করার যোগ্যতা আমার নেই, আমি শুধু গরীবের সস্তা গায়ের কাপড়ই সেলাই করতে পারি। এ পারিনে।


হরেন্দ্র বিপদে পড়িল। শেষে কহিল, এ তার ভারী ইচ্ছে। কিন্তু পাছে আপনি জানতে পারেন, পাছে আপনার মনে হয় আমরা কোনমতে আপনাকে কিছু দেবার চেষ্টা করচি, সেই ভয়ে অনেকদিন আমি স্বীকার করিনি। তাকে বলেছিলাম অল্পমূল্যে সাধারণ একটা কোন কাপড় কিনে দিতে। কিন্তু সে রাজী হ’লো না। বললে, এ ত আমার নিত্যব্যবহারের মেরজাই নয়, এ কমলের হাতের তৈরী জামা, এ শুধু বিশেষ উপলক্ষ্যে পর্বদিনে পরবার। এ আমার তোলা থাকবে। এ জগতে তার চেয়ে বেশী শ্রদ্ধা বোধ করি আপনাকে কেউ করে না।


কমল বলিল, কিছুকাল পূর্বে ঠিক এর উল্টো কথাই তাঁর মুখ থেকে বোধ করি অনেকেই শুনেছিল। নয় কি? একটু চেষ্টা করলে আপনারও হয়ত স্মরণ হবে। মনে করে দেখুন ত?


এই সেদিনের কথা, হরেন্দ্রর সমস্তই মনে ছিল; একটু লজ্জা পাইয়া বলিল, মিথ্যে নয়; কিন্তু এ ধারণা ত একদিন অনেকেরই ছিল। বোধ হয় ছিল না শুধু আশুবাবুর, কিন্তু তাঁকেও একদিন বিচলিত হতে দেখেচি। আমার নিজের কথাটাই ধরুন না, আজ ত আর প্রমাণ দিতে হবে না, কিন্তু সেদিনের কষ্টিপাথরে ঘষে ভক্তি-শ্রদ্ধা যাচাই করতে চাইলে আমিই বা দাঁড়াই কোথায়?


কমল জিজ্ঞাসা করিল, রাজেনের খোঁজ পেলেন?


হরেন্দ্র বুঝিল, এই-সকল হৃদয়-সম্পর্কিত আলোচনা আর একদিনের মত আজও স্থগিত রহিল। বলিল, না এখনো পাইনি। ভরসা আছে এসে উপস্থিত হলেই পাবো।


কমল বলিল, সে আমি জানতে চাইনি, পুলিসের জিম্মায় গিয়ে পড়েচে কিনা এই খোঁজটাই আপনাকে নিতে বলেছিলাম।


হরেন্দ্র কহিল, নিয়েছি।আপাততঃ তাদের আশ্রয়ে নেই।


শুনিয়া কমল নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না বটে, কিন্তু স্বস্তিবোধ করিল।জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কোথায় গেছেন এবং কবে গেছেন, মুচীদের পাড়ায় চেষ্টা করে একটু খোঁজ নিলে কি বার করা যায় না? হরেনবাবু, তাঁর প্রতি আপনার স্নেহের পরিমাণ জানি, এ-সকল প্রশ্ন হয়ত বাহুল্য মনে হবে, কিন্তু ক’দিন থেকে এ ছাড়া কিছু আর আমি ভাবতেই পারিনে, আমার এমনি দশা হয়েছে। এই বলিয়া সে এমনি ব্যাকুলচক্ষে চাহিল যে, হরেন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই সে মুখ নামাইয়া পূর্বের মতই সেলাইয়ের কাজে আপনাকে নিযুক্ত করিয়া দিল।


হরেন্দ্র নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিল। এই সময়ে এক-একটা প্রশ্ন তাহার মনে আসে, কৌতূহলের সীমা নাই—মুখ দিয়া কথাটা বাহির হইয়া পড়িতেও চায়, কিন্তু নিজেকে সামলাইয়া লয়। কিছুতেই স্থির করিতে পারে না, এ জিজ্ঞাসার ফল কি হইবে। এইভাবে পাঁচ-সাত মিনিট কাটার পরে কমল নিজেই কথা কহিল। সেলাইটা পাশে নামাইয়া রাখিয়া একটা সমাপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, থাক আজ আর না। এই বলিয়া মুখ তুলিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, এ কি, দাঁড়িয়ে আছেন যে! একটা চৌকি টেনে নিয়ে বসতেও পারেন নি?


বসতে আপনি ত বলেন নি।


বেশ যা হোক। বলিনি বলে বসবেন না?


না। না বললে বসা উচিতও নয়।


কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতেও ত বলিনি—দাঁড়িয়ে বা আছেন কেন?


এ যদি বলেন ত আমার না দাঁড়ানই উচিত ছিল। ত্রুটি স্বীকার করচি।


শুনিয়া কমল হাসিল, বলিল, তা হলে আমিও দোষ স্বীকার করচি। এতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা আমার অপরাধ। এখন বসুন।


হরেন্দ্র চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিলে কমল হঠাৎ একটুখানি গম্ভীর হইয়া উঠিল। একবার কি একটু চিন্তা করিল, তাহার পরে কহিল, দেখুন হরেনবাবু, আসলে এর মধ্যে যে কিছুই নেই এ আমিও জানি, আপনিও জানেন। তবু লাগে। এই যে বসতে বলতে ভুলেচি, যে আদরটুকু অতিথিকে করা উচিত ছিল, করিনি,— হাজার ঘনিষ্ঠতার মধ্যে দিয়েও সে ত্রুটি আপনার চোখে পড়েচে। না না, রাগ করেছেন বলিনি, তবুও কেমন যেন মনের মধ্যে একটু লাগে। এ সংস্কার মানুষের গিয়েও যেতে চায় না—কোথায় একটুখানি থেকেই যায়। না?


হরেন্দ্র ইহার তাৎপর্য বুঝিল না, একটু আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। কমল বলিতে লাগিল, এর থেকে সংসারে কত অনর্থপাতই না হয়। অথচ, এইটিই লোকে সবচেয়ে বেশি ভোলে। না?


হরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, এ-সব আমাকে বলচেন, না আপনাকে আপনি বলচেন? যদি আমার জন্যে হয়, ত আর একটু খোলসা করে বলুন। এ হেঁয়ালি আমার মাথায় ঢুকচে না।


কমল হাসিয়া বলিল, হেঁয়ালিই বটে। সহজ সরল রাস্তা, মনেই হয় না যে বিপত্তি চোখ রাঙিয়ে আছে। চলতে হোঁচট লেগে আঙুল দিয়ে যখন রক্ত ঝরে পড়ে, তখনি কেবল চৈতন্য জাগে—আর একটুখানি চোখ মেলে চলা উচিত ছিল। না?


হরেন্দ্র কহিল, পথের সম্বন্ধে হাঁ। অন্ততঃ আগ্রার রাস্তায় একটু হুঁশ করে চলা ভাল,— ও দুর্ঘটনা আশ্রমের ছেলেদের প্রায়ই ঘটে। কিন্তু হেঁয়ালি ত হেঁয়ালিই রয়ে গেল, মর্মার্থ উপলব্ধি হ’ল না।


কমল কহিল, তার উপায় নেই হরেনবাবু। বললেই সকল কথার মর্ম বোঝা যায় না। এই দেখুন, আমাকে ত কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু অর্থ বুঝতেও বাধেনি।


হরেন্দ্র বলিল, তার মানে আপনি ভাগ্যবতী, আমি দুর্ভাগা। হয় সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকে এমনি ভাষায় বলুন, না হয় থামুন। চিনে-বাজির মত এ যত চাচ্চি খুলতে, তত যাচ্চে জড়িয়ে। অজ্ঞাত অথবা অজ্ঞেয় বাধা থেকে বক্তব্য আরম্ভ হয়ে যে এ কোথায় এসে দাঁড়াল তার কূল-কিনারা পাচ্চিনে। এ-সমস্ত কি আপনি রাজেনকে স্মরণ করে বলচেন? তাকে আমিও ত চিনি, সহজ করে বললে হয়ত কিছু কিছু বুঝতেও পারবো। নইলে এভাবে ঘুমন্ত মানুষের বক্তৃতা শুনতে থাকলে নিজের বুদ্ধির পরে আস্থা থাকবে না।


কমল হাসিমুখে বলিল, কার বুদ্ধির পরে? আমার না নিজের?


দুজনেরই।


কমল বলিল, শুধু রাজেনকেই নয়, কি জানি কেন, সকাল থেকে আজ আমার সকলকেই মনে পড়চে। আশুবাবু, মনোরমা, অক্ষয়, অবিনাশ, নীলিমা, শিবনাথ,—এমন কি আমার বাবা—


হরেন্দ্র বাধা দিল, ও চলবে না। আপনি আবার গম্ভীর হয়ে উঠচেন। আপনার বাপ-মা স্বর্গে গেছেন, তাঁদের টানাটানি আমার সইবে না। বরঞ্চ, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের কথা, আপনি রাজেনের কথা বলতে চাচ্ছিলেন—তাই বলুন আমি শুনি। সে আমার বন্ধু, তাকে চিনি, জানি, ভালবাসি,—আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি আশ্রমই করি আর যাই করি, আপনাকে ঠকাবো না, সংসারে আরও পাঁচজনের মত ভালবাসার গল্প শুনতে আমিও ভালবাসি।


কমলের গাম্ভীর্য সহসা হাসিতে ভরিয়া গেল, প্রশ্ন করিল, শুধু পরের কথা শুনতেই ভালবাসেন? তার বেশিতে লোভ নেই?


হরেন্দ্র বলিল, না। আমি ব্রহ্মচারীদের পাণ্ডা—অক্ষয়ের দল শুনতে পেলে আমায় খেয়ে ফেলবে।


শুনিয়া কমল পুনশ্চ হাসিয়া কহিল, না, তারা খাবে না, আমি উপায় করে দেবো।


হরেন্দ্র ঘাড় নাড়িয়া বলিল, পারবেন না। আশ্রম ভেঙ্গে দিয়ে পালিয়ে গিয়েও আর আমার নিস্তার নেই। অক্ষয় একবার যখন আমাকে চিনেছে, যেখানেই যাই সৎপথে আমাকে সে রাখবেই। বরঞ্চ, আপনি নিজের কথা বলুন। রাজেনকে যে ভুলে থাকতে পারেন না—আবার সেইখান থেকে আরম্ভ করুন। কি করে সেই লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়াটাকে এতখানি ভালবাসলেন আমার শুনতে সাধ হয়।


কমল কহিল, ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি বারে বারে আপনাকে আপনি করি।


সন্ধান পান না?


না।


পাবার কথাও নয়। এবং সত্যি বলে আমার বিশ্বাসও হয় না।


কেন বিশ্বাস হয় না?


সে যাক। মনে হচ্ছে আগে একবার বলেছি। কিন্তু আরও ভাল ক্যানডিডেট আছে। মীমাংসা চূড়ান্ত করবার আগে তাদের কেসগুলো একটুখানি নজর করে দেখবেন। এইটুকু নিবেদন।


কিন্তু কেস ত অনুমানে ভর করে বিচার করা যায় না, হরেনবাবু, রীতিমত সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে হয়। সে করবে কে?


তারা নিজেরাই করবে। সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে প্রস্তুত হয়েই আছে, হাঁক দিলেই হাজির হয়।


কমল জবাব দিল না, মুখ তুলিয়া চাহিয়া একটুখানি হাসিল। তাহার পরে সমাপ্ত ও অসমাপ্ত সেলাইয়ের কাজগুলা একে একে পরিপাটি ভাঁজ করিয়া একটা বেতের টুকরিতে তুলিয়া রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, আপনার বোধ করি চা খাবার সময় হয়েছে হরেনবাবু, একটুখানি তৈরি করে আনি, আপনি বসুন।


হরেন্দ্র কহিল, বসেই ত আছি। কিন্তু জানেন ত চা খাবার আমার সময় অসময় নেই, কারণ পেলেই খাই, না পেলে খাইনে। ওর জন্যে কষ্ট পাবার প্রয়োজন নেই। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?


স্বচ্ছন্দে।


অনেকদিন আপনি কোথাও যাননি। ওটা কি ইচ্ছে করেই বন্ধ করেছেন?


কমল আশ্চর্য হইয়া বলিল, না। এ আমার মনেও হয়নি।


তা হলে চলুন না আজ আশুবাবুর বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। তিনি সত্যিই খুব খুশী হবেন। সেই অসুখের মধ্যে একবার গিয়েছিলেন; এখন ভাল হয়েছেন। শুধু ডাক্তারের নিষেধ বলে বাইরে আসেন না, নইলে হয়ত একদিন নিজেই এসে উপস্থিত হতেন।


কমল বলিল, তাঁর পক্ষে আশ্চর্য নয়। যাওয়া আমারই উচিত ছিল, কিন্তু কাজের ঝঞ্ঝাটে যেতে পারিনি। অন্যায় হয়ে গেছে।


তা হলে আজই চলুন না?


চলুন। কিন্তু সন্ধ্যেটা হোক। আপনি বসুন, চট করে এক বাটি চা নিয়ে আসি। এই বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।


সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে উভয়ে পথে বাহির হইয়া হরেন্দ্র বলিল, একটু বেলা থাকতে গেলেই ভাল হতো।


কমল কহিল, হতো না। চেনা লোক, কেউ হয়ত দেখে ফেলতো।


দেখলেই বা। ও-সব আমি গ্রাহ্য করিনে।


কিন্তু আমি এখন গ্রাহ্য করি।


হরেন্দ্র মনে করিল পরিহাস, কহিল, কিন্তু ওই চেনা লোকেরাই যদি শোনে আপনি আমার সঙ্গে একলা বার হতে আজকাল সঙ্কোচবোধ করেন, কি তারা ভাবে?


বোধ হয় ভাবে ঠাট্টা করচি।


কিন্তু আপনাকে যে চেনে সে কি অন্য কিছু ভাবতে পারে? বলুন? এবার কমল চুপ করিয়া রহিল।


জবাব না পাইয়া হরেন্দ্র বলিল, আজ আপনার যে কি হয়েছে জানিনে, সমস্তই দুর্বোধ্য।


কমল বলিল, যা বোঝবার নয় সে না বোঝাই ভাল। রাজেনকে যে ভুলতে পারিনে—এ সবচেয়ে বেশী টের পাই আপনি এলে। তার আশ্রমে স্থান হ’লো না, কিন্তু গাছতলায় থাকলেও তার চলে যেতো, শুধু আমিই থাকতে দিইনি, আদর করে ডেকে এনেছিলাম। ঘরে এলো, কিন্তু কোথাও মন বাধা পেলে না। হাওয়া-আলোর মত সব দিক খালি পড়ে রইলো, পুরুষের যেন একটা নূতন পরিচয় পেলাম। এ ভাল কি মন্দ, ভেবে দেখবার সময় পাইনি,—হয়ত বুঝতে দেরি হবে।
হরেন্দ্র কহিল, এ মস্ত সান্ত্বনা।


সান্ত্বনা? কেন?


তা জানিনে।


কেহই আর কথা কহিল না—উভয়েই কেমন একপ্রকার বিমনা হইয়া রহিল।


হরেন্দ্র ইচ্ছা করিয়াই বোধ করি একটু ঘুর-পথ লইয়াছিল, আশুবাবুর বাটীতে আসিয়া যখন তাহারা পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা অনেকক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেছে। খবর দিয়া ঘরে ঢুকিবার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু দিন পাঁচ-ছয় হরেন্দ্র আসিতে পারে নাই বলিয়া বেয়ারাটাকে সুমুখে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু ভাল আছেন?


সে প্রণাম করিয়া কহিল, হ্যাঁ, ভালই আছেন।


তাঁর ঘরেই আছেন?


না, উপরে সামনের ঘরে বসে সবাই গল্প করচেন।


সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে কমল জিজ্ঞাসা করিল, সবাইটা কারা?


হরেন্দ্র কহিল, বৌদি—আর বোধ হয় কেউ—কি জানি।


পর্দা সরাইয়া ঘরে ঢুকিয়া দুজনেই একটু আশ্চর্য হইল। এসেন্স ও চুরুটের কড়া গন্ধ একত্রে মিশিয়া ঘরের বাতাস ভারী হইয়া উঠিয়াছে। নীলিমা উপস্থিত নাই, আশুবাবু বড় চেয়ারের হাতলে দুই পা ছড়াইয়া দিয়া চুরুট টানিতেছেন, এবং অদূরে সোফার উপরে সোজা হইয়া বসিয়া একজন অপরিচিতা মহিলা। ঘরের কড়া আবহাওয়ার মতই কড়া ভাব—বাঙালীর মেয়ে, কিন্তু বাংলা বলায় রুচি নাই। হয়ত, অভ্যাসও নাই। হরেন্দ্র ও কমল ঘরে পা দিয়াই শুনিয়াছিল তিনি অনর্গল ইংরাজি বলিয়া যাইতেছেন।


আশুবাবু মুখ ফিরিয়া চাহিলেন। কমলের প্রতি চোখ পড়িতেই সমস্ত মুখ তাঁহার আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বোধ করি একবার উঠিয়া বসিবার চেষ্টাও করিলেন, কিন্তু হঠাৎ পারিয়া উঠিলেন না। মুখের চুরুটটা ফেলিয়া দিয়া শুধু বলিলেন, এসো কমল, এসো। অপরিচিতা রমণীকে নির্দেশ করিয়া কহিলেন, ইনি আমার একজন আত্মীয়া। পরশু এসেছেন, খুব সম্ভব এখানে কিছুদিন ধরে রাখতে পারব।


একটু থামিয়া বলিলেন, বেলা, ইনি কমল। আমার মেয়ের মত।


উভয়ই উভয়কে হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।


হরেন্দ্র কহিল, আর আমি?


ওহো—তাও ত বটে। ইনি হরেন্দ্র—প্রফেসর অক্ষয়ের পরম বন্ধু। বাকী পরিচয় যথাসময়ে হবে,—চিন্তার হেতু নেই হরেন্দ্র। কমলকে ইঙ্গিতে আহ্বান করিয়া কহিলেন, কাছে এসো ত কমল, তোমার হাতখানি নিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসি। এইজন্যে প্রাণটা যেন কিছুদিন থেকে ছটফট করছিল।


কমল হাসিমুখে তাঁহার কাছে গিয়া বসিল এবং দুই হাত বাড়াইয়া তাঁহার মোটা ভারী হাতখানি কোলের উপর টানিয়া লইল।


আশুবাবু সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, খেয়ে এসেচো ত?


কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, না।


আশুবাবু ছোট্ট একটু নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, জেনেই বা লাভ কি? এ বাড়িতে খাওয়াতে পারবো না ত!


কমল চুপ করিয়া রহিল।

No comments:

Post a Comment